শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ গডফাদারখ্যাত কুখ্যাত অপরাধী শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলীর মালিকানাধীন বাড়ি ’বাইতুল আমান’ নামক ভবনটি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে এক্সকেভেটর দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে বিক্ষুব্ধরা। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় অবস্থিত এই বাইতুল আমান থেকেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটা আন্দোলন-সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল ’বায়তুল আমান’।
কিন্তু গত ১৭ বছর যাবৎ রাজনীতি মুক্ত অবস্থায় ছিলো এই ভবনটি। কিন্তু ওসমান পরিবারের রক্তের সম্পর্কই কাল হয়ে দাড়াঁলো বাইতুল আমানে বসবাস করা খান সাহেব ওসমান আলীর (শামীম ওসমানের দাদা) চার ছেলের পরিবারের।
জানা যায়, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দুই জীবিত প্রতিনিধি জাতীয় পার্টি নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান, আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানসহ তাদের পরিবারের দুই সন্ত্রাসী ছেলে অয়ন ও আজমেরী ওসমান কেউ এই বাসায় থাকতেন না।
কখনো কোন দিন অথবা একদিনের জন্যওএই বাড়িতে এসে থাকতেন কিনা তা নিয়ে ও রয়েছে সন্দেহ। যাকে ঘিরে এই বাসা গত কয়েক যুগ ধরেই রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ বিছিন্ন।
জানা গেছে, শামীম ওসমানের বাবা এ কেএম শামসুজ্জোহা পরিবারের সাথে জীবদ্দশায়ও তার সৎ ভাই সারোয়ার পরিবারের ননী, মনি, সারোয়ারসহ মাসুদ সারোয়ার পুল্লু, বুলবুল সারোয়ার পারিবারের কোন সম্পৃক্ততাই ছিল না।
এমনকি শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান কিংবা নাসিম ওসমানের পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার চাচাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা পাওয়া ছিল খুবই দুর্লভ চিত্র। বরং শামীম ওসমান এবং তার ভাইদের হাতে তার চাচার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময় লাঞ্ছিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। এই বাসায় বেশির ভাগই থাকতেন ক্যান্সারে আক্রান্ত আলেয়া সারোয়ার এবং তার জা (দেবরের স্ত্রী) ডেইজি সারোয়ার দুজনই শারীরিকভাবে অসুস্থ।
গত বছরের জুলাই মাসের ১২ তারিখে রোহান ওসমান শাহেদের বিয়েতে ওসমান পরিবারের কোন সদস্যকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে সর্বশেষ ২০ মিনিটের জন্য এসেছিলেন শামীম ওসমান ও তার স্ত্রী লিপি ওসমান। জানা গেছে, এই পরিবারের বসবাস করাদের মধ্যে পুরুষ ছিলো না বলা চলে। কারণ শামীম ওসমানের সেই চার চাচাদের মধ্যে কেউ বেঁচে নেই। এ ছাড়া এর মধ্যে তাদের ছেলে সন্তান যারা রয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে ঢাকা চাকুরী করেন আবার অনেকেই দেশের বাহিরে থাকেন। বাড়ির পিছনে থাকা কিছু দোকান ও টুকটাক ছেলের পাঠানো টাকায় চলতো পরিবারটি।
কখনো ওসমান পরিবারের কাছ থেকে কোন প্রকারের সুবিধা আনতে যায়নি বলে দাবী করেছেন চাচী আলেয়া সারোয়ার ও চাচী ডেইজি সারোয়ার।
সূত্র জানায়, শুধু মাত্র রক্তের সম্পর্কের কারণেই গত ৫ আগষ্টের দিন ভাঙচুর-হামলা-লুটপাটের শিকার হয় পরিবারটি। এ সময় পরিবারের কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। এর পর পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হয়ে আসলে বিভিন্নভাবে ধার নিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করে সংস্কার করেন দরজা-জানালাসহ পানির মটরের লাইন, কারেন্ট লাইন মেরামত করা হয়। এরপর আর থাকা হলো না বাড়িটিতে। গত ৬ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় বাইতুল আমান ভবন টি ভাংতে স্থানীয় বিএনপি নেতারা মিছিল করে এসেই এক্সকেভেটর দিয়ে ভেঙে ফেলে বিক্ষুব্ধরা।
ভূক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, ভেঙ্গে ফেলার কয়েকঘণ্টা আগেেএমন খবর পান তারা। তখন জেল প্রশাসকের পাশাপাশি মহানগর বিএনপির দুই নেতা সাখাওয়াত ও টিপুসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বিকে ফোন করেন তারা। তা ছাড়া খান সাহেব ওসমান আলীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান শামসুজ্জোহা। শামসুজ্জোহার তিন ছেলে নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান এবং শামীম ওসমান। এরা সবাই রাজনীতি সাথে জড়িত । তবে বাইতুল আমানে খান সাহেব ওসমান আলীর যেই সন্তান ও তাদের পরিবারের লোকজন থাকতেন তারা কেউ রাজনীতি সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কখনো। এরপরও বায়তুল আমান ভাঙার পেছনে বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য ছিলো বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনের সাথে সাথে পতন ঘটে ওসমানীয় অপরাধ সাম্রাজ্যের। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দুই জীবিত প্রতিনিধি জাতীয় পার্টি নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান, আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান দুইজনই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান।
নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ওসমান সাম্রাজ্য ছিল যেমন আতঙ্কের নাম, তেমনি তীব্র ঘৃণা ছিল মানুষের অন্তরে অন্তরে। আর সেই কারণে ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জামতলায় শামীম ওসমানের বাড়ি, উত্তর চাষাঢ়ায় তার পৈত্রিক বাড়ি হীরা মহলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় চাষাঢ়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী যে বাড়িতে থাকতেন সেই বায়তুল আমানে ও হামলা ও লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটলে ও ভাঙা হয়নি বাড়িটি।
তাহলে ঘটনার ছয় মাস পর ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কেন বায়তুল আমানে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হল, আর কারাই বা এই হামলার নেপথ্যে ছিল ? কী বা ছিল এর উদ্দেশ্য, সে এক অপার রহস্য ! ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডটি সম্প্রসারণ করার জন্য যেখানে সরকারিভাবে আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল চাষাঢ়ার মোড়ে অবস্থিত বায়তুল আমান ভবন এবং রাইফেল ক্লাব ভবন দুটি ভেঙে ফেলা হবে, সেখানে কেনই বা আগে ভাগে বায়তুল আমান গুঁড়িয়ে দিয়ে কোন গোষ্ঠীকে ফায়দা লুটার সযোগ দেয়া হল ?
এরআগে ২০০১ সালে বাড়িটি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তখন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী বাধা হয়ে দাঁড়ান ভবনটি ভাঙ্গার বিষয়ে। তা ছাড়া ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শামীম ওসমানের আসন হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান শামীম ওসমানের চাচা শফিউদ্দিন সারায়োর ওরফে বাবু সারোয়ারের সাবেক স্ত্রী প্রয়াত চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী।
ওই সময় ৫ বছর এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করলেও এক মুহুর্তের জন্য শামীম ওসমান ও তার ভাইয়েরা তাকে শান্তিতে কাজ করতে দেননি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় দেখা গেছে,শামীম ওসমান প্রকাশ্যেই তার চাচী সারাহ বেগম কবরীকে লাঞ্ছিত করেন। কবরীর স্বাভাবিক কাজকর্ম যাতে বিঘ্নিত হয় এ কারণে শামীম ওসমান তাঁর ক্যাডার বাহিনীকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সময় চাচাদের সাথে শামীম ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের সাপে-নেউলে সম্পর্ক দেখেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।
প্রয়াত খান সাহেব ওসমান আলীর ছেলে প্রয়াত আল মামুন সারোয়ারের (ননী সারোয়ার) স্ত্রী আলেয়া সারোয়ার বলেন, বাইতুল আমান ভেঙ্গে ৪ জন বিধাবা নারীকে ঘরহীন করা হলো। গত ৫ তারিখে একবার লুট হয়েছে। আমরা কোনভাবে প্রায় ৫ লাখ টাকা নিয়ে ঠিকঠাক করেছি। কিন্তু আজ তা আবারো ভেঙে চুরমার করে আমার রাস্তায় নামিয়ে দিলো। এদিকে লোকমুখে খবর পেয়ে আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে ফেলার আগে বিএনপির এড. সাথাওয়াত ভাই ও টিপুকে ফোন করেছিলাম কিন্তু তারা কোন গুরুত্ব দেয়নি। এর বিচার আল্লাহ করবেন একদিন। আমরা কেন এই নির্যাতনের শিকার হবো আমরা যারা এখানে থাকতাম কেউ রাজনীতির সাথে কখনো জড়িত ছিলাম না। শামীম ওসমানের বাবা খান সাহেব ওসমান আলীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান জোহা সাহেব রাজনীতি করতো। কিন্তু তারা কেউ এই বাড়িতে থাকতেন না। তারা উত্তর চাষাড়ার হীরা মহলে জন্ম হয়েছে। তারা এই বাড়িতে আসতো না আমরাও সেখানে যেতাম না। এগুলো তো সবাই জানতো। শুধু রক্তের সম্পর্ক থাকায় আজ আমাদের এই দশা।
এমন ঘটনায় মাসুদ সারোয়ার পুল্লুর স্ত্রী ডেইজি সারোয়ার বলেন, শামীম ওসমানরা রাজনীতি করতো। ওদের বাড়ি তো ভাঙা হয়েছে । আমরা তো কিছুর সাথে যুক্ত ছিলাম না। আমাদের বাড়ি কেন ভাঙ্গা হলো। আমি এখন অন্যের বাড়িতে থাকছি। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরছি। এভাবে কয়দিন থাকবো ? আমাদের আর এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। আমাদের অপরাধ হলো আমরা এই পরিবারে বৌ হয়ে এসেছি। আমরা কোনো অন্যায় করি নাই। খেতে পারলে খেয়েছি নাইলে না খেয়ে থেকেছি। ওদের (শামীম ওসমান) কাছেও কখনো যাইনি। তারপরও আমরা আক্রান্ত হলাম। এখন আমরা যারা পরিবারের রয়েছি আমাদের ছেলে-মেয়েরা রয়েছি আমরা সকলেই আলোচনা সাপেক্ষে পদক্ষেপ নিবো। এ ছাড়া দ্রুত জেলা প্রশাসক সাহেবের সাথেও বাড়ি ও জায়গার বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।